ছাত্র রাজনীতির
অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ
ছাত্র রাজনীতির মূল লক্ষ্য হচ্ছে সমাজ, দেশ ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানে নিজেকে গড়ে তোলা। এটা শুধু বাংলাদেশের
ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়। পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে বিশেষ করে অনুন্নত ও তৃতীয়
বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকতা দুর্বল, সেখানে ছাত্র
রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। যেহেতু
ছাত্ররা সমাজের অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ সচেতন অংশ, সেহেতু জাতীয় ও
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ছাত্র সমাজের বিশেষ ভূমিকা অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে জার্মানি
ও অস্ট্রিয়ার বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল ছাত্র সমাজ। ‘জার’ আমলে রাশিয়ায়
ছাত্ররাই বিভিন্ন বিপ্লবী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। এমনকি ১৯৫৫ সালে
আর্জেন্টিনায়, ১৯৫৮ সালে ভেনিজুয়েলায়, ১৯৬০ সালে কোরিয়ায় ছাত্র সমাজ পালন
করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। ১৯৬৪ সালে দ. ভিয়েতনাম ও বলিভিয়ার ক্ষেত্রেও
জাতীয় সংকটে ছাত্র সমাজের অবদান ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত
হিসেবেই বিবেচিত হবে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতি ত্রিয়মান কোনো ঘটনা নয়। এদেশও ভূখণ্ডের জন্মের সঙ্গে মিশে আছে ছাত্র রাজনীতির গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। বিশেষ করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ’৬২-র কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন, ’৬৬-র ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা, ’৬৯-র গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-র নির্বাচন, ’৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনসহ প্রতিটি ঐতিহাসিক বিজয়ের প্রেক্ষাপট তৈরি ও আন্দোলন সফল করার ভ্যানগার্ড হিসেবে তৎকালীন ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা অপরিসীম। পরবর্তীতে ’৯১-র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও এদেশের ছাত্র রাজনীতির রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহাসিক ভূমিকা। আর এ কারণেই জনগণের কাছে ছাত্র রাজনীতির আলাদা একটা গ্রহণযোগ্যতা আমাদের দেশে ছিল এবং এখনও কিছুটা রয়েছে।
যে সফলতার ইতিহাস এতক্ষণ বললাম সেখানে কারা নেতৃত্বের আসনে ছিল, তাদের বৈশিষ্ট্য কী ছিল, পরবর্তী জীবনে দেশের জন্য তাদের অবদান কী ছিল সেগুলো ব্যাখ্যা না করলে বর্তমান ছাত্র রাজনীতির পোস্টমর্টেম সম্ভব হবে না। ওই সময় ছাত্র রাজনীতিতে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের দূষণ পরিলক্ষিত হয়নি। সবচেয়ে মেধাবী ছাত্ররাই নেতৃত্বে আসতেন এবং তারা সমাজে সাধারণ মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মান পেতেন। ব্যক্তিস্বার্থ বা আর্থিক সুবিধার জন্য কেউ ছাত্র রাজনীতি করতেন না।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যে ছাত্ররা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পরবর্তীতে তারা প্রত্যেকেই এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে একেকটি পিলার হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন। এমনকি তারা প্রায় সবাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েছেন। ওই সময়ের ছাত্র রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল প্রগতিশীল দর্শন
হিসেবে, জীবনবোধ ও সৃজনশীলতা তৈরির অনুঘটক হিসেবে কাজ করার জন্য। সেই আমলে
ছাত্রদের রাজনীতি ও আন্দোলন করার মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয়
স্বার্থরক্ষা এবং অধিকার সচেতনতা ছিল। দেশ ও দেশের মানুষের স্বাধিকার ও
অধিকার আদায়ের তীব্র বাসনা কাজ করত ছাত্রদের মধ্যে। বিভিন্ন আন্দোলন ও
সংগ্রামে তাদের মধ্যে তীব্র আবেগ কাজ করত। যেই আবেগ দিয়ে তারা তথাকথিত
পশ্চিমা শিক্ষিতদের কূটকৌশল, সশস্ত্র পাকিস্তানিদের শোষণ আর স্বৈরাচার
সামরিক শাসকের বেয়নেটের হুংকারকে পরাজিত করতে পেরেছিল।
গত তিন দশকে ছাত্র রাজনীতির চারিত্রিক ও গুণগত মান ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছে। ’৭৫-র পটপরিবর্তন, সামরিক শাসনগুলো ছাত্র রাজনীতিকে বৈষয়িক স্বার্থকেন্দ্রিক করে তোলে। ওই সময়ে ছাত্র রাজনীতি তার চিরায়ত গণমুখী ঐতিহ্য বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতামুখী দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে শেখে। তাই ছাত্র রাজনীতি আর আধিপত্যের সম্পর্ক একটি আরেকটির অভিযোজন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে পড়ে। হারিয়ে যাওয়া ছাত্র রাজনীতির সর্বোচ্চ হাতিয়ার ছিল লেখাপড়া, বইখাতা, কাগজ-কলম, লাঠি-বিড়ি। আর এখনকার ছাত্র রাজনীতির হাতিয়ার হল- মদ-গাঁজা, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভাড়ায় শক্তি প্রদর্শন, মাদক বাণিজ্য, ভর্তি বাণিজ্য, হলে সিট বাণিজ্য, ইভটিজিং, নারী নির্যাতন, কাটা রাইফেল, রিভলবার। এগুলোর পরে যদি সম্ভব হয় তাহলে কিছুটা লেখাপড়া আর নামকাওয়াস্তে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ শুধু ছাত্রত্ব ধরে রাখার জন্য। তাও নাকি বর্তমান সময়ের ছাত্রনেতারা নিয়মিত করেন না। যথাসময়ে পাস করে বের হয়ে গেলে নাকি পদ-পদবিপ্রাপ্ত নেতা হওয়া যায় না। যারা বর্তমান ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্বে রয়েছে, তাদের প্রথমেই হতে হবে অপেক্ষাকৃত মেধাশূন্য অথবা ভান করতে হবে কিছুই জানে না এমন, হতে হবে ভালো চামচা, থাকতে হবে পেশিশক্তি ও সন্ত্রাস সৃষ্টির সামর্থ্য। এগুলো থাকলেই উপরের আশীর্বাদ পাওয়া যাবে এবং ‘উজ্জ্বল’ ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা মিলবে।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতি আমাদের দেশ ও জনগণের সামনে দেখা দিয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে। জনগণ এখন আর ছাত্র নেতাদের আগের মতো সম্মান করে না। ছাত্র রাজনীতিকেও জনগণ সহজভাবে ও ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে না। জনগণ ছাত্র রাজনীতির প্রতি ভীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছে। এর কারণ কী? তরুণ ও মেধাবী ছাত্ররা আজকে কেন রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছে? কিছু শিক্ষাঙ্গনে আজকে কেন লিখে দেয়া হচ্ছে ‘ছাত্র রাজনীতি মুক্ত’? বর্তমান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বলে, ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার মাধ্যমে একজন ছাত্র নিজের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ, নিজেকে সন্ত্রাসী বা চোরাকারবারির বা অন্যের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে গড়ে তোলে।
বর্তমানে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছাত্রদের সাধারণ মানুষ আদর্শহীন, চরিত্রহীন, অর্থলোভী, মাস্তান, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ, মূর্খ সর্বোপরি সমাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর মানুষ বলে মনে করেন। কিন্তু এ কথাও সত্য এবং ইতিহাস দ্বারা প্রমাণিত, ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই রাজনৈতিক ব্যক্তিদের প্রাথমিক ভিত তৈরি হয়েছে এবং আদর্শবান ছাত্র নেতারাই রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। সেই ৫২, ৬২, ৬৯, ৭১, ৯০-এর ঐতিহ্য আজ অনুপস্থিত। বর্তমানে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো ভালো কাজ সফলতার মুখ দেখে না। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, সরকার ও প্রশাসনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের ছাত্র সংগঠন এমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি করে রাখে যেখানে প্রতিযোগিতার কোনো পরিবেশ থাকে না। যেখানে ভিন্নমত, ভিন্নদল থাকবে না, সেখানে মেধাবী নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে না। ছাত্র রাজনীতিকে আবার দেশপ্রেমিক ও যোগ্য নেতৃত্বের সূতিকাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইলে ক্যাম্পাস ও হলগুলোতে সব রাজনৈতিক মত ও দলের সহাবস্থান নিশ্চিত করা জরুরি। প্রতিদ্বন্দ্বি^তা নয়, প্রতিযোগিতার সংস্কৃতিই পারে ছাত্র রাজনীতিকে সাধারণ মানুষের কাছে আবার গ্রহণযোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে। রাতের আঁধার যতই গভীর হোক না কেন, সকালের সূর্য অবশ্যই উদিত হবে। আমার বিশ্বাস নির্লোভ, আপসহীন ত্যাগের মানসিকতাসম্পন্ন দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের নেতৃত্বে অচিরেই ছাত্র রাজনীতি সুষ্ঠু ও সঠিক ধারায় ফিরে আসবে আর তখনই ছাত্র রাজনীতির প্রতি জনগণ আস্থাশীল হবে।
0 comments:
Post a Comment